বাংলাদেশকে কেন ভারতের বেশি প্রয়োজন?
২০২১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনের ৫০ বছর পূর্তি হবে। স্বাধীনতার অর্ধশতবর্ষ উদ্যাপনের উৎসবে যোগ দিতে যাবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই উৎসব উপলক্ষে হাজির হবে পৃথিবীর নানা দেশ। আর এই উৎসব হবে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে প্রস্তুতি হলো এক মস্ত বড়। প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক ঘটনা। অনেকেই জানে না, ঢাকা সরকার এখন থেকেই এই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। আবার এর আগে আগামী বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালনের উৎসবেও মোদি হাজির হতে ইচ্ছুক। সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দিল্লি এসে মোদির সঙ্গে দেখা করে এ অনুষ্ঠানের জন্য আমন্ত্রণ জানালে মোদি সঙ্গে সঙ্গে এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
বিগত ৩৫ বছরের সাংবাদিকজীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সফল কূটনীতিক হতে গেলে সব সময় খুব বেশি হৈচৈ করে সফল হওয়া যায় না। দিল্লিতে বর্তমান ঢাকার হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি সাংঘাতিক সক্রিয়; কিন্তু তাঁকে দেখলে সেটি টের পাবেন না। সৈয়দ মুজতবা আলীর এই ভাইপোকে বাঙালিরা, তা কলকাতারই হোক আর রাজধানীর, আপনজন বলে মনে করে। আবার দিল্লিতে খোদ বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক। জয়শঙ্কর যখন বিদেশসচিব ছিলেন তখন থেকেই এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এবার আসাদুজ্জামান খানের দিল্লি আসার কয়েক দিন আগে গিয়েছিলাম হাইকমিশনে। বাংলাদেশের মিনিস্টার প্রেস ফরিদ হুসেনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে টের পেলাম এই সফরকে কেন্দ্র করে বেশ তৎপরতা চলছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকার রেলমন্ত্রীও এসেছিলেন। সামগ্রিকভাবে এই সফর ইতিবাচক। এবার এ মাসেই বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর যাচ্ছেন ঢাকা। তারপর অক্টোবর মাসের ৩-৪ তারিখ নাগাদ ভারতের দুর্গাপূজা এবং দীপাবলি উৎসবের আগেই শেখ হাসিনার দিল্লি আসার কথা। জয়শঙ্কর এবার ঢাকায় গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এই দিনক্ষণ চূড়ান্ত করবেন। আবার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী এখানে সম্প্রতি বৈঠক করে শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন।
এককথায় শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত রসায়ন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ নেই। অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর ঢাকার মনের মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। প্রথমত, অমিত শাহ নিজে একজন কট্টরবাদী নেতা বলে পরিচিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের বিষয়টি তিনি উত্থাপন করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি বাংলাদেশকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন। অমিত শাহ বিজেপির সভাপতি ছিলেন এত দিন। এখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি এই বিজেপির পছন্দের অনুপ্রবেশের বিষয়টি উত্থাপন করবেন, এ তো স্বাভাবিক। মনে করুন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদিও কলকাতায় গিয়ে বলেছিলেন ক্ষমতায় এসে অনুপ্রবেশ বন্ধ করা হবে। সত্যি কথা বলতে কি, এটি হলো বিজেপির মতাদর্শগত অবস্থান। দেবগৌড়া যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। সেদিন রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছিলাম শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে। শপথগ্রহণের পর তিনি বলেছিলেন, অনুপ্রবেশ নামক বিষয়টি যেভাবে দেখা হয়, তাতে সমস্যার সমাধান হবে না। এটি মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হলেই এই সমস্যার সমাধান হবে। গলা ধাক্কা দিয়ে বিদায় করলেও এ সমস্যার সমাধান হবে না। বস্তুত বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এই কমিউনিস্ট নেতার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। লালকৃষ্ণ আদবানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পরও কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। রাজনাথ সিংহের সময়ও হয়েছে। তাই এটি বিজেপির মতাদর্শগত বিষয়। যেমন—ট্রাম্প বেআইনি নাগরিকদের আমেরিকা ছাড়ার হুংকার দিচ্ছেন। অভিবাসন গোটা পৃথিবীতেই রক্ষণশীল রাজনীতিবিদদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। খোদ বাংলাদেশও তো মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিব্রত।
এর ওপর আছে নাগরিকত্ব বিল। শুধু আসামে এটি বাস্তবায়িত করতে গিয়ে এবং বেআইনি নাগরিকদের নামের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেও প্রবল বিতর্কের মুখে পড়েছে মোদি সরকার। সরকার প্রথমে বলেছিল যে শুধু আসামে, এখন তো বলা হয়েছে এটি গোটা দেশেই বাস্তবায়িত হবে। সরকারের যুক্তি হলো, কোনো দেশে কি অন্য কোনো দেশের মানুষ ভিসা ছাড়া আসতে পারে? থাকতে পারে অনির্দিষ্টকালের জন্য? এহেন পরিস্থিতিতে বিজেপির এই বক্তব্য ভোট প্রচারেও তাদের বড় একটা ইস্যু। কিন্তু রাজনীতিতে অ্যাপিয়ারেন্স এবং রিয়ালিটির মধ্যে সব সময় থাকে অনেকটা ফারাক। বিদেশনীতিতে দুটি শব্দ খুব ব্যবহৃত হয়—একটি হলো desire, অন্যটি হলো effective desire; একটি হয় আদর্শ ইচ্ছা, সেটি নিঃশর্ত প্রত্যাশা। কিন্তু বিদেশনীতি শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিরিখে নির্ধারিত হয় না। দেখতে হয় দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করা কতখানি প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীতে আজ কোনো দেশই বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ওপর নিরন্তর প্রভাব বিস্তার করে। উদাহরণ দিয়ে বলি, ইসরায়েল ঘোরতর ইরানবিরোধী। দিল্লিতে ইসরায়েল দূতাবাসের কূটনীতিকদের ওপর ইরানি জঙ্গিরা আক্রমণ হেনেছিল। আজও এ ব্যাপারে ভারত কোনো কড়া ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ ইসরায়েল সরকারের অন্দর মহলে। ঘটনাটি যখন ঘটে তখন মনমোহন সিং ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। এ ঘটনার তদন্ত হওয়ার আগেই ন্যামের বৈঠকে যোগ দিতে মনমোহন সিং ইরান চলে যান। আমি নিজে মনমোহনের সঙ্গে সেবার ইরান গিয়েছিলাম। মনমোহনকে ইরান প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে ভারতের পাশে রাখা প্রয়োজন। কারণ ইরান হলো প্রতিবেশীর প্রতিবেশী। তা ছাড়া আছে তেলের ইস্যু। ইসরায়েলের ভালো না লাগলেও ইরানের ব্যাপারে ভারতের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে তারা নাক গলায়নি। এর বদলে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষাসহ অন্য সব বিষয়ে তাদের সম্পর্ক বিস্তারে সক্রিয় হয়। ইসরায়েলের ওপর ভারতের কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বদলে আজ সুষ্ঠু সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিদেশনীতিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে অনেক সময়ই বহুপক্ষীয় পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হয়। বিশ্বরাজনীতি খণ্ড খণ্ড নয়, আসলে অখণ্ড। এর অনেক স্তর থাকে।
বাংলাদেশের সঙ্গে অনুপ্রবেশের বিষয়ে সংঘাতে যাওয়া আজ ভারতের অগ্রাধিকার হতে পারে না। আজ ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুযুধান সম্পর্ক। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের perspective-টাই বদলে দিতে চাচ্ছে। এই যে বারবার বন্ধুত্ব গড়ার চেষ্টা, তারপর আবার যুদ্ধ—এই দোদুল্যমানতা থেকে ভারত বেরিয়ে আসতে চায়। বিশেষত ৩৭০ ধারার ভিত্তিতে কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের বিষয়গুলো প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এবার পাকিস্তান আরো মরিয়া।
বেশ ফ্যাসাদে পড়েছেন ইমরান খান। ডন পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে তাঁর। বলা হয়েছে, আমেরিকায় গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করে কী হাসিল করলেন ইমরান? এদিকে পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা এখন এক গভীর সংকটে। বরং বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের তুলনায় অর্থনৈতিক প্রশ্নে অনেক মজবুত। এ অবস্থায় পাকিস্তান চেষ্টা করবে ভারতে কোনো একটি সন্ত্রাস ঘটাতে। কাশ্মীর উপত্যকায় যদি সফল হয় পাকিস্তান কোনো নতুন সন্ত্রাসে, তাহলে ইমরানের সম্মান বাঁচে। কিন্তু এর সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
তবে সতর্ক ভারত। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল কাশ্মীর উপত্যকায় বসে আছেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশের জিওস্ট্র্যাটেজিকের গুরুত্ব অপরিসীম। আবার চীন-পাকিস্তান সাবেকি অক্ষ সুবিদিত। ভারত চীনের সঙ্গেও বিবাদে না গিয়ে বাণিজ্য নিয়ে আবার আলাপ-আলোচনা শুরু করে দিয়েছে। চীনের ক্ষেত্রে ডোকলাম-কাণ্ড আপাতত ভুলে গেছে ভারত। দিল্লিতে কর্মরত পাকিস্তানের এক কূটনীতিক বলছিলেন, আপনারা চীনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়ে গেলেন আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বারবার বলা সত্ত্বেও বলছেন সন্ত্রাস বন্ধ না হলে আলোচনা হবে না। চীন কি ভারত সম্পর্কে মনোভাব বদলেছে, না ডোকলাম নিয়ে অবস্থানে কোনো বদল এনেছে? তাহলে চীন শক্তিশালী বলে এই আপস আর আমরা দুর্বল বলে হম্বিতম্বি! এই বক্তব্য শুনে বুঝলাম, পাকিস্তান কতটা চাপের মধ্যে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সমর্থন খুব জরুরি। বাংলাদেশের জন্য তাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে মোদি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে শুধু কথা বলেছেন তা-ই নয়, সে কথা ঢাকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েও দিয়েছেন। প্রথমে মোদি যখন মিয়ানমারে যান তখন সু চি আর শেখ হাসিনার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেন। যুক্তি ছিল, চীন মিয়ানমারে অর্থ ও প্রভাব বাড়াচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ভারতের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে। হাসিনার দিল্লির দূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারত সরকারকে এই অসন্তোষ জানান।
ভারত জানে চীন বাংলাদেশেও প্রভাব বাড়াতে চাচ্ছে। শুধু পদ্মা সেতুর প্রকল্পের জন্য অর্থ জোগান নয়, এবার চীন সফরে হাসিনাকে যতখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা-ও তাৎপর্যপূর্ণ।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ককে মজবুত রাখা ভারতের প্রধান অগ্রাধিকার।
লেখক :
জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি
জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি
No comments